প্রথমে পেনাল্টি শটে গোল দিলেন মেসি। ইতিহাসে নাম লেখালেন। এরপর মেসির অ্যাসিস্টে ডি মারিয়ার অসাধারণ গোল। লুসাইল স্টেডিয়াম তখন থর থর করে কাঁপছে। আর ডি মারিয়া! তিনি তখন কাঁদছেন। শুকনো গড়নের এই ‘অমরত্ব’ লাভকারীর চোখ থেকে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সেভাবেই তিনি বলের পিছনে দৌড়াচ্ছেন। এ কান্না বড় মধুর। মানুষ কষ্টে কাঁদে। তাতে কষ্ট লাঘব হয়।কিন্তু মানুষ আনন্দেও কাঁদে। এই কান্না মিষ্টিমধুর। এই কান্নায় মন ভরে যায়। কষ্টে মানুষ কাঁদলে তাকে দেখে কষ্ট হয়। আনন্দে কাঁদলে হাসতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে হয়- কাঁদো। এ কান্না তোমাকে বড্ড মানিয়েছে।
ডি মারিয়া ও বাহিনীর সবাই তখন অনেকটাই নিশ্চিত জয় তাদেরই হতে যাচ্ছে। বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা যা খেলেছে, তার প্রশংসা যেকেউ করবেন। এ সময় বেশির ভাগই বল ছিল আর্জেন্টিনার দখলে। ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা কার্যত তাদের পিছু পিছু দৌড়েছেন। ফলে আর্জেন্টিনা কমপক্ষে ২-০ তেই কেল্লাফতে করে দেবেন এমন ধারণা দর্শক ও ভক্তদের মধ্যে গেঁথে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেলার গতি পাল্টে যায়। আর্জেন্টিনা দৃশ্যত রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে যায়। আমি খেলা বুঝি না। তবু আমার কাছে মনে হয়েছে, এই সিদ্ধান্তটাই তাদের জন্য আত্মঘাতী হয়েছে। কারণ, যখন প্রতিপক্ষ রক্ষণাত্মক অবস্থানের মধ্যে আসে, তখনই ডি-বক্সের মধ্যে জড়াপল্টা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর তা থেকে গোল অথবা পেনাল্টি পাওয়ার আশঙ্কা জেগে ওঠে। হলোও তাই। এমবাপ্পে পেনাল্টিতে গোল করলেন। আর্জেন্টাইন ভক্তদের গা তখন থর থর করে কাঁপা শুরু হয়েছে। খেলায় কিছুটা গতি পরিবর্তন করে আর্জেন্টিনা। তারা এবার কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়। কিন্তু ফাঁক পেয়ে সেই এমবাপ্পে খেলায় অসাধারণভাবে সমতা আনেন। উল্লাসে ফেটে পড়েন ফ্রান্সের দর্শক, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন আর ব্রাজিলের বাংলাদেশি ভক্তরা।
শিরদাড়া বেয়ে হিমশীতল বার্তা পৌঁছে যায় শরীরে। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে খেলা। হাতছাড়া হয়ে যায় আর্জেন্টিনার। ২-০ তে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনার এই অবস্থা দেখে পানি পান করতে থাকেন ভক্তরা। গলাবুক শুকিয়ে যায়। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। আর্জেন্টিনা বেশ কয়েকটি সুযোগ মিস করে। নির্ধারিত সময়ে ২-২ সমতায় শেষ হয় খেলা। অতিরিক্ত সময়ে আর্জেন্টিনা আরও এক গোল করে সেই হিমঘরে থাকা নার্ভকে স্ফুটনাংকে তুলে দেয়। তাও সেই মেসি। যার জন্য কোটি কোটি মানুষ দু’হাত তুলে প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু সিংহের মতো গর্জন করতে থাকেন এমবাপ্পে। খেলার অল্প কয়েক মিনিট বাকি। তখনই তিনি চৌকস এক গোল দিয়ে আবার খেলায় সমতা আনেন ৩-৩।
আবার নিভে যায় গ্যালারি। আবার প্রাণপ্রদীপ যেন ভক্তদের নিভে যায়। মৃত্যুর পূর্বক্ষণের মতো নীরবতা ছেয়ে যায়। কাউকে চিমটি কাটলেও যেন ব্যথা পাবেন না। ঠিকই ৩-৩ এ খেলা শেষ হয়। এরপরই আসে পেনাল্টি কিক। তাতে যা হয়েছে, তা ইতিহাস সাক্ষী। মেসিকে ওই এমিলিয়ানো মার্টিনেজ কথা দিয়েছিলেন, তিনি মেসিকে কাপ এনে দেবেন। তাই করলেন। ঠেকিয়ে দিলেন একটি পেনাল্টি। আর একটি পেনাল্টি গোলবারের বাইরে দিয়ে চলে গেল।
আর্জেন্টাইন শিবির তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে। উদগীরণের পূর্বমুহূর্তে আগ্নেয়গিরির ভিতর যেমন লাভা টগবগ করে, তেমনি ভিতরে ভিতরে টগবগ করছিলেন ভক্তরা। মন্টিয়েলের পেনাল্টি কিকে জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আগ্নেয়গিরির উদগীরণ হলো। না, ভিসুভিয়াসের চেয়ে তীব্র গতি তার। পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু। পূর্ব থেকে পশ্চিম। প্রতিটি স্থান প্রকম্পিত হলো। মানুষ রাস্তায় নেমে এলেন। মেসি মেসি স্লোগানে তখন দেশে দেশে অলিতে গলিতে স্লোগান। মিছিল। আকাশে তারাবাজির উৎসব।
তখন উল্লাসের পাশাপাশি অন্য এক দৃশ্য চোখে পড়ে।
মেসিকে এদিন তেমন কাঁদতে দেখা যায়নি। কিন্তু অঝোরে কাঁদছিলেন তার বাজপাখি এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। বেঞ্চে বসে কাঁদছিলেন ডি মারিয়া। কাঁদছিলেন ফার্নান্দেজ। কাঁদছিলেন মন্টিয়েল। কাঁদছিলেন না কে! এমন আনন্দে মানুষ না কেঁদে পারে না। খেলার আগে টিম আর্জেন্টিনা কথা দিয়েছিল- তারা মেসির জন্য খেলবে। তারা মেসিকে কাপ এনে দিতে চায়। সেই কথা তারা রাখতে পেরেছে। ইতিহাসের মহানায়ককে সম্মানীত করতে পেরেছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে ম্যারাডোনার সঙ্গে সঙ্গে মেসির নাম যুক্ত হয়েছে ইতিহাসে। এই স্বর্ণালী অধ্যায়ের সঙ্গী হতে পেরে তারা নিজেরাও গর্বিত। টিম আর্জেন্টিনাকে তাই স্যালুট জানাতেই হয়।
খেলা শেষে এমি মার্র্টিনেজ যখন কমেন্ট্রি দিচ্ছিলেন, যারা দেখেছেন, তিনি তখন অঝোরে কাঁদছিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। দু’হাতে বার বার চোখ মুছছিলেন। কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিল। শিশুর মতো কাঁদছিলেন মার্টিনেজ। তার এই কান্নাও ইতিহাস হয়ে থাকলো। মেসিকে তিনিই সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভয় করো না। গোলপোস্টে দেয়াল তুলে দেব। কাপ তোমার হাতেই দেবো। মার্টিনেজ শেষ পর্যন্ত তাই করলেন।
Leave a Reply